হাওজা নিউজ এজেন্সি: ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার রক্ষা না করা—বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সিতে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা—এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। এটি শুধু চুক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং ভবিষ্যতে কোনো অর্থবহ ও টেকসই চুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় আস্থাকেও নষ্ট করেছে।
একটি নতুন চুক্তি হতে গেলে ইরানের প্রত্যাশাগুলোকে গৌণ শর্ত হিসেবে নয়, বরং চুক্তির মূল উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ইরানের অবস্থানের কেন্দ্রে রয়েছে একটি অপরিবর্তনীয় দাবি: প্রতিবন্ধকতামুক্ত, যাচাইযোগ্য ও অপরিবর্তনীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। এটি ছাড়া কোনো প্রকৃত চুক্তি সম্ভব নয়।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: ইরানের মূল দাবি
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সবসময়ই নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নের সাথে জড়িত, এমনকি এটি পরমাণু প্রযুক্তির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের জন্য জেসিপিওএ (JCPOA) শুধু একটি পরমাণু চুক্তি ছিল না, এটি ছিল একটি অর্থনৈতিক সুযোগ। দেশটি তার পরমাণু সক্ষমতা সীমিত করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সেই সুবিধা কখনই পূর্ণরূপে মেলেনি, এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার আগেও না।
জেসিপিওএ অভিজ্ঞতা থেকে ইরান একটি মূল শিক্ষা নিয়েছে: নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের গৌণ নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা এখনও বড় বাধার মুখে পড়েন। আরও খারাপ হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেখিয়েছে যে, কীভাবে সহজেই এই ধরনের অঙ্গীকারগুলো উল্টে দেওয়া যায়।
আর তাই, ইরান এবার কাগজে-কলমে নিশ্চয়তার চেয়ে বেশি কিছু চাইছে।
ইরানের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মাজিদ শাকেরি বলেন, বর্তমান আলোচনাগুলোতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা—অর্থাৎ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করা—নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু ইরান কী পাবে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি স্থিতিশীল বা যৌক্তিক চুক্তি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু প্রায় সব আলোচনাই যুক্তরাষ্ট্রের লাভের দিকে কেন্দ্রীভূত, যেমন বিভিন্ন নামে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করা—হয়তো অস্থায়ী স্থগিতাদেশ বা আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে। কিন্তু ইরান কী পাবে, তা নিয়ে কিছুই বলা হয় না।”
তিনি যুক্তি দেন যে, শুধু সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো ইরানের জন্য পর্যাপ্ত লাভ নয়। “ওয়াশিংটন যদি সত্যিই সামরিক হামলা করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থামাতে চাইত এবং সে ক্ষমতা রাখত, তাহলে তারা এক সেকেন্ডও দেরি করত না। তাই যুক্তি বলে যে, একটি টেকসই চুক্তিতে ইরানের জন্য পরিমাপযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা থাকতে হবে।”
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বাস্তব অর্থনৈতিক সুবিধা
শাকেরির মতে, ইরানের শুধু ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার’-এর পরিবর্তে অর্থনৈতিক সুবিধা—বা তার ভাষায়, পরিমাপযোগ্য মুনাফা—এর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, নিষেধাজ্ঞা ইরানের উপর চাপ দেওয়ার অনেকগুলো হাতিয়ারের মধ্যে একটি মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক, পেটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়নের মতো অন্যান্য উপায়ও ব্যবহার করে, যা সাধারণত নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না। তাই শুধু ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার’-এ মনোযোগ দেওয়া ভুল।”
তিনি বলেন, ইরানের আলোচক দলকে যুক্তরাষ্ট্রের পরিমাপযোগ্য পরমাণু দাবির বিনিময়ে পরিমাপযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা দাবি করতে হবে। “আমেরিকানরা যদি আইএইএ (IAEA) বা যুক্তরাষ্ট্র-সম্পর্কিত তদারকির মাধ্যমে যাচাইযোগ্য সীমাবদ্ধতা চায়, তাহলে ইরানকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাইযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা চাইতে হবে।”
শাকেরি মনে করেন, একটি কৌশলগত পরিবর্তন উভয় পক্ষের জন্য উপকারী হতে পারে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের শক্তির বিনিময় না করে, বরং একে অপরের দুর্বলতাকে পূরণের ভিত্তিতে চুক্তি করতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন যে, ইরানের শিল্প বিকাশের জন্য মূলধনী পণ্য প্রয়োজন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র—বিশেষ করে ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনে—ওপেক+ এবং রাশিয়া ও সৌদি আরবের বাড়তি তেল উৎপাদনের চাপে তার শক্তি আধিপত্য ধরে রাখার উপায় খুঁজছে।
এই পরস্পরপূরক চাহিদাগুলো উভয় পক্ষের জন্য জয়-জয় সমাধানের সুযোগ তৈরি করে, যেখানে রাজনৈতিক ছাড় বা কূটনৈতিক অপমানের প্রয়োজন নেই- তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, যে কোনো টেকসই চুক্তি আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে জড়িত না হয়ে সরাসরি, পারস্পরিক ও উভয় পক্ষের মূল চাহিদাভিত্তিক হতে হবে।
সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা ও অগ্রগতির পথ
শনিবার ইমাম খোমেনির মাজারে এক সফরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির অধিকার একটি মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি- তা হচ্ছে: বিদেশি আধিপত্যের বিরোধিতা।
তিনি বলেন, “সমৃদ্ধি নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু আরও গভীরে, আমাদের আলোচনার মূল নীতি হলো আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করা।”
রোমে যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের পঞ্চম দফা পরোক্ষ আলোচনার পর আরাকচি এটিকে আমাদের আলোচনার ইতিহাসের সবচেয়ে পেশাদার রাউন্ডগুলোর একটি বলে অভিহিত করেন এবং নিশ্চিত করেন যে ইরানের সম্পূর্ণ স্পষ্ট অবস্থান দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একইসাথে, ইরানের পরমাণু প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ইরানের পরমাণু নীতি জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত, বিদেশি নির্দেশনা দ্বারা নয়।
ইরানের জন্য, কোনো পরমাণু চুক্তি কূটনৈতিক ইশারার চেয়ে বেশি কিছু হতে হবে—এটি একটি বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক চুক্তি হতে হবে যা পরিমাপযোগ্য ও সুরক্ষিত সুবিধা প্রদান করে। ইরানি কর্মকর্তারা একমত যে, নিশ্চিত ও বাস্তব সুবিধা ছাড়া পরমাণু কর্মসূচিকে আলোচনার চিপ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
আর সেই সুবিধাগুলোকে ভবিষ্যতের যুক্তরাষ্ট্রি প্রশাসনের রাজনৈতিক খামখেয়ালি থেকে সুরক্ষিত থাকতে হবে।
একটি টেকসই চুক্তির পথ শুধু সেন্ট্রিফিউজ হল বা তদারকি তালিকার মধ্য দিয়ে নয়, বরং বন্দর, ব্যাংক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়েও যায়। শুধুমাত্র যখন উভয় পক্ষ বাধ্য ও উপকৃত হবে, তখনই একটি পরমাণু চুক্তি সত্যিকারভাবে বাস্তবায়নযোগ্য হবে।
সূত্র: তেহরান টাইমস, মেহর নিউজ
আপনার কমেন্ট